গায়ের রং শ্যামলা হওয়ায় প্রায়সই অনেকের অবহেলার স্বীকার হতে হয় চন্দ্রাকে। চন্দ্র আর রাত্রি একই বাবা মায়ের দুই সন্তান। চন্দ্রার চেয়ে রাত্রি ২ বছরের ছোট। চন্দ্রার বয়স ১১ আর রাত্রির ৯, রাত্রির গায়ের রং ফর্সা, তবে তার আর তেমন কোনো ইতিবাচক দিক নেই বললেই চলে। যদিও গায়ের রং তার নিজের অর্জিত কোনো বিষেশণ নয় তবুও তার কথাবার্তায় চলাফেরায় কেমন যেনো একটা অহংকারের ইঙ্গিত দৃশ্যমান। অতি চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটি পড়াশোনায় একেবারেই অমনোযোগী। বয়স মাত্র ৯ বছর হলেও রুপচর্চায় ১৫/১৬ বছরের মেয়েকে হার মানাতে পারে সে। হাতে লালা চুড়ি, চুলে ফিতা, কাজল,আলতা, লিপস্টিক, নকপলিশসহ কয়েক প্রকার প্রসাধনী সবই আছে তার কাছে। আসলে এই প্রসাধনীসমুহ তার একার নয় এতে চন্দ্রারও ভাগ আছে কিন্ত রাত্রি এগুলো একাই ব্যাবহার করে। ব্যাপারটা এমনও নয় যে চন্দ্রার এগুলোর বা সে ব্যাবহার করতে অনিচ্ছুক। পক্ষান্তরে চন্দ্রা একেবারেই রাত্রির বিপরীত। মার্জিত ব্যাবহার, বুদ্ধি বিবেচনা এবং পড়াশোনায়ও সে রাত্রির চেয়ে অনেক এগিয়ে।
কিন্ত একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনরা সবাই চন্দ্রার চেয়ে রাত্রিকেই বেশী পছন্দ করে। বাড়িতে কোনো মেহমান বেড়াতে আসলে সবাই রাত্রির খোজটা আগে করে। এই ব্যাপারটা আরো আগে থেকেই ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। যখন চন্দ্রা ও রাত্রি অনেক ছোটো ছিল তখনও সবাই রাত্রিকে কোলে নিয়ে আদর করত।
আর চন্দ্রা মেহমানদের গা ঘেষে দাড়িয়ে থাকত। প্রায় সবাই রাত্রিকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকত। সাথে করে নিয়ে আসা চকলেট কিংবা অন্য কিছু প্রথমেই রাত্রির হাতে দিত। আপনি ভাবতে পারেন হয়ত রাত্রি ছোট তাই তাকে সবাই একটু বেশীই ভালোবাসত! না মোটেই না কারণ রাত্রি আর চন্দ্রার বয়সের ব্যাবধান খুব একটা বেশী না। যাইহোক চন্দ্রা আর রাত্রি দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেছে চন্দ্রা এবার এস এস সি পরিক্ষার্থী, ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী । দুই বোন এক সাথে গ্রামের মেঠো পথ ধরে কোচিং করতে যায়। কোচিং এ যাওয়ার রাস্তায় পাশের গ্রামের ফাহিম নামের এক কলেজ পড়ুয়া ছেলে মোটরসাইকেল রাস্তায় রেখে প্রায় প্রতিদিনই এদিক সেদিক হাটাচলা করে। সুযোগ পেলে আড় চোখে চন্দ্রাকে দেখে। কোচিংএ যাওয়ার পথে প্রতিদিনই ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে, এতেকরে চন্দ্রা ও রাত্রি বিরক্তিত হলেও কাউকে কিছু বলতে পারে না।
কারন ছেলেটা তাদের কোনো প্রকার বাজে ইঙ্গিত করে না বা কথাও বলতে চায় না। পরের দিন কোচিং শেষে ফেরার সময়
দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল ছেলেটার হাতে একটা বাক্সের মত। কাছাকাছি যেতেই রাত্রিকে ডাক দিলো ফহিম: এই রাত্রি একটু শুনবে?
রাত্রি: কি?
ফাহিম: আসো তারপর বলছি।
চন্দ্রা বলল এই কোথাও যেতে হবে না বাড়ী চল।
রাত্রি : তুই একটু দাড়া আমি শুনে আসছি কি বলতে চায় কারন রোজ রোজ এভাবে বিরক্ত হওয়ার চেয়ে একদিনে যদি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বলা যায় তাহলে হয়ত ও আমাদের আর বিরক্তের কারন হবে না।
চন্দ্রা : তাই? তাহলে যা, ভালোভাবে বুঝিয়ে বলিস কারন ও তো আমাদের কোনোদিনও বিরক্ত করেনি তাই না বল।
রাত্রি : কিরে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস নাতো?
ফাহিম: দুই বোনে বাড়ী গিয়ে যতক্ষণ খুশী কানাকানি করিও কেউ বাধা দিবে না, এখানে আমাদের কেউ দেখে নিলে মন্দ কিছু ভাবতে পারে।
রাত্রি হনহন করে হেটে ফাহিমের কাছে গিয়ে হাতদুটো দিয়ে নিজের কেমর ধরে চোখদুটো অন্যদিক করে জিজ্ঞেস করলো কি বলবেন বলেন।
ফহিম তার হাতে থাকা বাক্সটা রাত্রির হাতে দিল এবং বুক পকেট থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে অন্য হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, রাত্রি আমি তোমার বোন চন্দ্রাকে অনেক পছন্দ করি, চন্দ্রাকে বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না তাই তোমার মাধ্যমে বললাম, তুমি ওকে বলিও ওকে ছারা আমি কোনোকিছু ভাবতে পারি না।
এই বলে রাত্রির কোনো কথা না শুনেই ফাহিম মোটরসাইকেল স্টার্ট করে চলে গেলো।
ফাহিমের দেওয়া বাক্স এবং গোলাপ ফুলটি নিয়ে তার মোটরসাইকেলের পিছনে তাকিয়ে থেকে চন্দ্রার কাছে এসে বলল দেখ ছেলেটা আমাকে এগুলো দিয়েছে,
চন্দ্রা : তোকে দিয়েছে?
রাত্রি: তুই কি ভেবেছিলি তোকে দিয়েছে? এই বলে রাত্রি হাসতে লাগল।
চন্দ্রা: চল এবার বাড়ী যাই (মাথানিচু করে বলল)
রাত্রি : চল এমনি দেরি হয়ে গেছে, শোন না চন্দ্রা একটা কথা তুই আজকের দিনের কথা বাড়ীতে বা কোচিংএ কাউকে বলিস না কেমন!
চন্দ্রা: আমি কাউকে কিছুই বলব না, ভয় পাস না।
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বাড়ীতে চলে এসেছে।
সন্ধায় দুজনে পড়তে বসে।কিছুক্ষণ পর রাত্রি স্কুল ব্যাগে লুকিয়ে রাখা বাক্সটা বের করল, বাক্সটা গিফ্ট কাগজে মোড়ানো ছিল তাই ধীরে ধীরে কাগজটি বাক্স থেকে আলাদা করল।
চন্দ্রা এক মনে অংক করেই যাচ্ছে এমন সময় রাত্রি বাক্সটি খুলে দেখল একটা গলার হার আর একটুকরো কাগজে লেখা, ''আই লাভ ইউ চন্দ্রা"
রাত্রি সাথে সাথে কাগজটি লুকিয়ে ফেলে এবং চন্দ্রাকে বলে দেখ চন্দ্রা কত সুন্দর হার দিয়েছে ফাহিম আমাকে।
চন্দ্রা: হুম খুব সুন্দর হার, এটা গলায় দিয়ে বাবা-মাকে সালাম করে আয়!
চন্দ্রা : ঠাট্টা করিস না তো!
রাত্রি : চন্দ্রা শোন আমাকে একটা চিঠি লিখে দিবি? তোর হস্তলিপি আমার চেয়ে অনেক ভালো।
চন্দ্রা: আচ্ছা দেবো, বল কিভাবে শুরু করব?
এই বলে রাত্রির কথমতো চন্দ্রা চিঠি
লিখে দিলো। পরের দিন সকালে কোচিংএ যাওয়ার সময় ফাহিমকে দেখতে পেয়ে রাত্রি তার কাছে গিয়ে চিঠিটা দিয়ে কোচিংএ চলে যায়।
এভাবে চিঠি আদান প্রদান হচ্ছিল রাত্রির সাথে ফাহিমের।
ফাহিম ভাবল চিঠি দিয়ে আর কতদিন এবার একটু সামনা সামনি কথা বলতে হবে।
এবারের চিঠিটায় ফাহিম চন্দ্রার সাথে মুখোমুখি কথা বলার আবদার জানায়, চিঠি পেয়ে রাত্রি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। সে বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করবে! চন্দ্রাকে সবখুলে বলবে নাকি ফাহিমকে সবকিছু জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। নাকি পুরো ব্যাপারটা এরিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে।
সেই রাতে চন্দ্রার সাথে রাত্রির ফহিম সম্পর্কে বা চিঠি লেখালেখি নিয়ে আর কোনো কথ হয়নি।
পরেরদিন সকালে কোচিং এর উদ্দেশ্যে দুই বোন রওনা হলো, প্রতিদিনের মতো তারা গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছিল রাস্তায় ফাহিমকে দেখে রাত্রি আজকে পাশকাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় চন্দ্রা বলে ডাক দিলো ফাহিম। চন্দ্রা, রাত্রি দুজনেই অবাক হলো, কারন এর আগে কোনোদিন ফাহিম চন্দ্রার নাম ধরে কোনোদিন ডাকেনি। যা বলার বা দেয়ার সবই রাত্রির হাতে দিয়েছিল। চন্দ্রা খানিকটা অবাক হয়ে বলল, কিছু বলবেন?
ফাহিমকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাত্রি চন্দ্রার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলো।
ফাহিম পিছন থেকে কয়েবার চন্দ্রা, চন্দ্রা বলে ডাক দিলো, রাত্রি একটিবারের জন্যও পিছনে তাকালে না।
চন্দ্রা পিছনে তাকিয়ে দেখল ফাহিম তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রা বার বার অবাক দৃষ্টিতে রাত্রির দিকে তাকালো কিন্ত কোনো কথা বলল না।
এরই মধ্যে তারা কোচিং শেষ করে বাড়ী ফিরে দেখল তাদের বাবা বাজার থেকে মাছ,মাংস বিভিন্ন রকম সবজি নিয়ে এসেছে এটা দেখে তারা দুজনই বুঝতে পারল কোনো মেহমান আসবে নিশ্চয়ই, কারন তারা তাদের বাবার এরকম কর্ম ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে।
রাত্রি এসব দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবা এতো বাজার করলে যে, কেউ আসবে?
আবুল কাশেম( চন্দ্রা,রাত্রির বাবা) : হুম তোদের মামাত ভাই আবির গতকাল রাতে ফোন করেছিলো, আজকেই আসছে আর হয়ত এক দের ঘন্টা সময় লাগবে।
রাত্রি : বাবা আবির ভাই তো প্রায় ১ মাস হলো দেশে এসেছে আমাদের সাথে দেখা করার এখন সময় হলো? আসুক দেখবো মজা।
বাবা: হাহা! আবির বিদেশে ব্যাবসা করে তার কি এতো সময় আছে আমাদের বাড়ী এসে বেড়ানোর?
যা তোরা এখন ঘরে যা,তোদের মায়ের সাথে কাজ কর।
রাত্রি চন্দ্রা ঘরে চলে গেলো দুজনেই পুকুর থেকে গোসল সেরে নিজেদের ঘরে আসল। রাত্রি তারাহুরো করে নিজেকে যতটা সম্ভব সজ্জিত করল।
চন্দ্রা : কিরে, আবির ভাই আসছে বলে নিজেকে তো মেলার পুতুলের মতো সাজিয়েছিস তোর গ্রাম্য সাজে কি আবির ভাইকে ভুলাতে পারবি?
রাত্রি: আমি মোটেও আবির ভাইকে ভুলানোর জন্য কিছু করছি না। আমি আমার মতো সেজেছি।
চন্দ্রা: যাক তাহলে আমি চেষ্টা করে দেখি আবির ভাইয়ের সাথে বিদেশে পারি জমাতে পারি কিনা কি বলিস?
রাত্রি : এই চন্দ্রা তোর বাচনভঙ্গি তো আমাকে রীতিমতো অবাক করছে রে।
কথোপকথনের মাঝেই কয়েক সেকেন্ডর জন্য রাত্রি চিন্তা করল, আমি চন্দ্রার চেয়ে সুশ্রী হওয়া সত্তেও ফাহিম আমাকে রেখে চন্দ্রাকে কেন পছন্দ করে?